দেশের কী হবে, কোথায় সংস্কার প্রয়োজন এইসব ভাবলে সবার আগে আমার মাথায় ঘুরপাক খায় দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বিষয়টা। আমি জানি, বাংলাদেশের মতো একটা দেশের জন্যে শিক্ষার চেয়েও আরো অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক খাত রয়েছে যেখানে সংস্কার প্রয়োজন। সবাইই কোনো না কোনো ক্ষেত্র নিয়ে কিছু না কিছু অবশ্যই ভাবছেন, ভেবে রেখেছেন। আমি আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানের পরিধিতে শিক্ষার দিকটা নিয়েই ছোটোখাটো স্বপ্ন দেখি।
ছোটোবেলা থেকেই এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা, বইপুস্তক, পাঠদানপদ্ধতি, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রভৃতি সকল দিক আমার কাছে বড্ড সীমিত সীমাবদ্ধ লাগতো। শিক্ষাখাতে এই অবধি যতো সংস্কার এসেছে আমার কাছে বরং তা আরো বেশি পশ্চাতগামী বলে অনুভূত হয়েছে। আর আমার এই ধারণা একেবারেই ফেলে দেওয়ার মতো নয় বলে বিশ্বাস করি কারণ এতোগুলো বছর ধরে এই জাতিকে পঙ্গু বানানোর যাবতীয় চেষ্টাই তো চালিয়ে যাওয়া হয়েছে, আর তার বড়ো ধরনের আঘাত হানা হয়েছে জাতির শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। আমি যখন আমার পূর্বের কয়েকটা জেনারেশনের শিক্ষাদীক্ষা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছি, বইপুস্তক খুঁটিয়ে দেখেছি, সেকেলে শিক্ষকদের সান্নিধ্যে গিয়েছে, তখন হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি সেই শঙ্কা, আমার অনুভূতি আরো জোরালো হয়েছে। কিছুদিন আগে যে নতুন কারিকুলামের যাত্রা শুরু হলো, আমরা সবাই মোটামোটি একবাক্যেই স্বীকার করে নেবো যে এ জাতিকে মূর্খ করে দাবিয়ে রাখার পাঁয়তারা সফল হওয়ার পথে।
বিগত কয়েক বছর যাবত আমাদের বাংলা মিডিয়াম এবং ইংরেজি ভার্সনের প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যবইগুলো পর্যবেক্ষণ করলে পাওয়া যাবে কনটেন্টের ভার, প্রাসঙ্গিকতা এবং গুণগত মানের চরম অধঃপতন। যেখানে ইংরেজি মিডিয়ামের কারিকুলামের দিকে তাকালে স্পষ্টতই বুঝতে পারে যায় কতোটা অগ্রসর এবং মানসম্মত কনটেন্টে সাজানো হয়েছে। সহজ করে বললে, আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা যে পড়া পড়তে পড়তে মাধ্যমিক পেরিয়ে যায়, বিশ্বের আর দশটা দেশের বাচ্চারা সে পড়াগুলো প্রাথমিকের শেষভাগে কিংবা নিম্নমাধ্যমিকের আগেই শিখে নিচ্ছে। স্কুল পর্যায় থেকেই বইয়ের পাশাপাশি জীবনের জন্যে প্রয়োজনীয় অনেক স্কিল এবং বহুমাত্রিক কারিগরি শিক্ষার প্রশিক্ষণ নিতে পারছে। দেশটা স্বাধীন হলে আমার চাওয়া থাকবে যেনো নতুন করে ঢেলে বহির্বিশ্বের উন্নত কারিকুলাম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদের দেশের সঙ্গে প্রাসঙ্গিকতা বজায় রেখে নতুন সময়োপযোগী মানসম্মত পাঠ্যপুস্তক ও কারিকুলাম তৈরি করা এবং তা প্রয়োগ করা হয়। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা যেনো পড়াশোনার দিক থেকে বাইরের দুনিয়া থেকে কয়েক বছর করে পিছিয়ে না থাকে, হঠাৎ করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভিন্নমাত্রিক পড়াশোনা দেখে যেনো হাহুতাশ না করতে হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। আরো একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, দেশের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে শিশুদের সামনে। এটা তো আমাদের সময়ের দাবি।
আমাদের দেশে ভালো শিক্ষকের অপ্রতুলতা আছে তা আমরা সকলেই জানি এবং মানি। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং স্বচ্ছ নিয়োগব্যবস্থা নিশ্চিত করার মাধ্যমে এই অভাব মিটিয়ে নেওয়া সম্ভব হলেও আমাদের চাই এর থেকেও বেশি কিছু। আমাদের প্রয়োজন সৎ এবং নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক, যারা নিজ প্রতিষ্ঠানের বাইরে শিক্ষা নিয়ে কুরুচিপূর্ণ ব্যবসা না করে শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিতে বদ্ধপরিকর থাকবেন। একইসঙ্গে পাঠদানপদ্ধতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোর পুনঃনির্মাণ এবং পুনর্বিন্যাস হবে এই প্রত্যাশায় বুক বেঁধে আছি।
এই সবকিছুই সম্ভব হবে দেশের সম্পূর্ণ রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সাংবিধানিক এবং আইনি মূলোৎপাটন এবং সফল প্রতিস্থাপনের পর। স্বাধীন বাংলাদেশে যেদিন সত্যি সত্যিই একটা যুগান্তকারী শিক্ষাব্যবস্থার গোড়াপত্তন হবে, সেদিন আমার খুশি কোনো বাঁধ মানবে না। আমি নিজের বেলায় যেমনটা চেয়েছি তেমনটা তো পাইনি, আর পাওয়ার সুযোগ হয়তো হবেও না। কিন্তু অন্তত আমার পরের জেনারেশন একটা চমৎকার শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে শিক্ষিত হয়ে উঠবে, তাদের আমার মতো কোনো খেদ বা অপূর্ণতা থাকবে না, পড়াশোনা নিয়ে ক্ষোভ থাকবে না — যদি বেঁচে থাকি তবে এই দৃশ্যপট নিজের চোখে দেখে যেতে চাই। দেশটা স্বাধীন হওয়ার পর আমরা প্রত্যেকটা নাগরিক নিজের মেধা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বল একীভূত করে একটা সুন্দর দেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে একযোগে কাজ করবো, এই দিবাস্বপ্ন বাস্তবে রূপান্তরিত হোক। এটাই বর্তমানে আমার প্রধান চাওয়া।
কলমে,
মুমতাহীনা রহমান তাজরী
সেশন ২০২১-২০২২,
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়